মইনুল আবেদীন খান সুমন,বরগুনা জেলা প্রতিনিধি:
সংখ্যালঘু ইউপি সদস্যের দোকানঘর ভাংচুর করে কয়েক লক্ষ টাকার মালামাল লুটপাটের একদিন পরে বসতবাড়িতে করা হয় হামলা। মারধর থেকে রেহাই এবং প্রাণ বাঁচাতে বাড়ির পাশের খাল সাঁতরে পলিয়ে যেতে হয়েছিলো। এমন অভিযোগ করে পাথরঘাটা উপজেলার একমাত্র হিন্দু সংখ্যালঘু ইউপি সদস্য অঞ্জন ভট্টাচার্য্য কালবেলাকে বলেন, স্থানীয় বিএনপির নেতা হাবিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের হুমকি-ধামকি ও মারধরের ভয়ে ছয়মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও অদ্যবদি স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারিনি। আজ এখানে তো কাল ওখানে এভাবেই মানবেতর জীবন পার করছি।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, ভুক্তভোগী অঞ্জন ভট্টাচার্য্য বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার ৭ নম্বর কাঠালতলী ইউনিয়নের ১নম্বর ওয়ার্ড থেকে জণভোটে তিনবারের নির্বাচিত সদস্য । বাড়ির পাশেই স্থানীয় নলী বাজারে মুদি-মনোহরির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। ইউপি সদস্য অঞ্জন ভট্টাচার্য্য রাজনৈতিকভাবে আওয়ামীলীগের সমর্থক ছিলেন।
ভুক্তভোগী ওই ইউপি সদস্য অঞ্জন ভট্টাচার্য্য মোবাইল ফোনে বলেন, ৫ই আগষ্ট পতিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পরলে পাথরঘাটা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ও কাঠালতলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ প্রভাবে ও মদদে স্থানীয় শামসুল হকের ছেলে ফরিদ ও তার ছেলে খলিল, ছিদ্দিক এবং হাবিবুর রহমানের দুই ছেলে তাদের বাহিনী নিয়ে তার দোকানে হামলাকরে ভাংচুর চালায়। এসময় দোকানে থাকা প্রায় পাঁচ থেকে সাত লক্ষ টাকার মালামাল ও আসবাবপত্র লুটপাট করে নিয়ে যায়। পরে দোকানটিতে শহীদ আবু সাইদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবিযুক্ত ব্যানার লাগিয়ে বিএনপি অফিস ঘোষণা করে।
পরেরদিন অর্থাৎ ৬ই আগষ্ট নলী বাজারের পাশেই অঞ্জন ভট্টাচার্য্যের বাড়িতে গিয়ে উল্লেখিত হাবিব বাহিনীর সদস্যরা হামলা চালিয়ে সামনে থাকা পানির ট্যাংকি, ঘরের দরজা, জানাল ভাংচুর করে এবং মারধরসহ প্রাননাশের হুমকি ধামকি দিতে থাকে। এসময় প্রাণ ভয়ে দুপুরের ভাত না খেয়েই বাড়ির পাশের খাল সাঁতরে পালিয়ে যান অঞ্জন ভট্টাচার্য্য। এসময় তার বসত ঘরে ঢুকে মূল্যবান মালামাল, একটি মোটরসাইকেল লুট করে নিয়ে যায়, বাকি আসবাবপত্র ভাংচুর করে। এমনকি পানি সেঁচের বৈদ্যুতিক মোটর, বাগানে গাছের নারিকেল ও সুপারিও নিয়ে যায় হামলাকারীরা।
ওই ইউপি সদস্য আরো জানান, ঘরবাড়ি ভাংচুর ও লুটপাটের সময় স্থানীয় নুরুল ইসলামের ছেলে জলিল তার (অঞ্জন ভট্টাচার্য্য) ঘরে থাকা দলিল-দস্তাবেজসহ মূল্যবান সকল কাগজপত্র আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। পরে নিজে নিরাপদে স্থানে গিয়ে স্ত্রী ও বিবাহযোগ্য কন্যাকে নিয়ে সেই থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ওই ইউপি সদস্য৷ খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন পার করছেন তিনি। এসব কথা বলতে বলতে কান্না জড়িত কন্ঠে তার সাথে ঘটে এমন ঘটনার সুষ্ঠ বিচারসহ নিরাপদে নিজ বাড়িতে ফিরে ভবিষ্যতে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন নির্যাতনের শিকার হয়ে সব হারানো এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ইউপি সদস্য।
কাঠালতলী ইউনিয়নের নলী এলাকায় গিয়ে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রভাবশালী বিএনপি নেতা হাবিবের ভয়ে সরাসরি মুখ খুলতে রাজি হয়নি স্থানীয়রা। তবে নাম গোপন রাখার শর্তে একাধিক এলাকাবাসী ভুক্তভোগী ওই ইউপি সদস্য অঞ্জন ভট্টাচার্য্যকে প্রকাশ্যে হুমকি ধামকি, হামলাসহ তার( অঞ্জন ভট্টাচার্য্য) দোকান ও বসতঘর ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা সত্য মর্মে স্বীকার করেছেন। তারা জানান, ২০২৪ সালের ৬ আগষ্ট উল্লেখিত বিএনপি নেতাদের ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে ইউপি সদস্য অঞ্জন ভট্টাচার্য্যককে। ছয়মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও অভিযুক্ত বিএনপি নেতাদের ভয়ে একটি বাড়ের জন্যও বাড়িতে আসতে পারেনি ভুক্তভোগী ওই ইউপি সদস্য। এখনো মাঝে মাঝে এসে বিএনপি নেতা হাবিবের অনুসারীরা এসে গাছের নারিকেল ও সুপারি নিয়ে যায়।
এলাকাবাসী আরো জানান, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওই ইউপি সদস্যের দোকানে লুটপাটের পর বিএনপি কার্যালয় তৈরি করেছিলো। পরে প্রশাসনিক চাপে সেখান (অঞ্জন ভট্টাচার্য্যের দোকান) থেকে টেবিল চেয়ার নিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি ঘরে বিএনপি অফিস করা হয়েছে।
এলাকায় গিয়েও অভিযুক্ত খলিল,ছিদ্দিক, জলিল কারোর সাথেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে পাথরঘাটা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ও কাঠালতলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান অভিযোগের বিষয় অস্বীকার করে বলেন, শুনেছি ৫ই আগষ্ট অঞ্জন মেম্বারের বাড়িতে হামলা হয়েছে। আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না, ঢাকায় ছিলাম। তাছাড়া এঘটনায় আমি বা আমার পরিবারের কেহ জড়িত নাই।
পাথরঘাটা উপজেলা বিএনপির আহবায়ক চৌধুরী মো: ফারুক হামলার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ইউপি সদস্য অঞ্জন ভট্টাচার্যের দোকানসহ বাড়িঘরে হামলা ও তার বাড়িতে না থাকার বিষয়টি আমরা লোকমুখে শুনেছি। তাকে বাড়িতে ফেরাতে ইতিমধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় দল ও দলের বাহিরের কিছু লোক জড়িত আছে। এব্যাপারে ইতিমধ্যে হাবিব চেয়ারম্যানসহ জড়িতদের দলীয় ও প্রশাসনিকভাবে শাসানো হয়েছে। বর্তমানে তার বাড়িতে ফিরতে কোন সমস্যা নেই।
পাথরঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার বা লুটপাটের এ বিষয়টি আমার নলেজে নাই। তিনি (অঞ্জন ভট্টাচার্য্য) বাড়ি ছাড়া এবিষয়টি আমার জানা নেই। তাছাড়া তিনি আইনি সহয়তা জন্যও থানায় যোগাযোগ করেন নি। তিনি আইনি সহয়তা চাইলে অবশ্যই তাকে আইনিসহয়তা করা হবে।
এবিষয়ে কথা বলতে পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান খানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি কল রিসিভ করেন নি।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ বরগুনা জেলা শাখার সদস্যসচিব জয়দেব রায় বলেন, গত ৫ই আগষ্ট ও ৬ ই আগষ্ট একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মীরা অঞ্জন ভট্টাচার্য্যের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট করে। সেই সময়ই তিনি প্রাণভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান এবং পরবর্তী সময়েও তার বাড়িতে হামলা হয়েছে। বর্তমানে অঞ্জন ভট্টাচার্য্য স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছেন, মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অদ্যবদি তিনি বাড়িতে আসতে পারেননি। অঞ্জন ভট্টাচার্য্য ও তার পরিবারের লোকজন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
অঞ্জন ভট্টাচার্য্য ও পরিবারকে আইনি সহয়তা ও নিরাপত্তা দিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের নিকট দাবী জানিয়ে এ সংখ্যালঘু নেতা বলেন, এ দেশ আমাদের সকলের। সকলে মিলে এ দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে চাই।
বরগুনা জেলা প্রশাসক শফিউল আলম বলেন, আমি এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কথা বলবো এবং ওনার (অঞ্জন ভট্টাচার্য্য) সাথে কথা বলবো। তাকে বরগুনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহয়তা করা হবে। যদি তিনি অপরাধ করে থাকেন সেটি ভিন্ন বিষয়। তাছাড়া বরগুনা শান্ত রয়েছে।